টেস্ট ম্যাচের মর্ম কতটা বোঝে বাংলাদেশ

দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথমটিতে আজ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ। প্রথম দিনের খেলা শেষে ৮৫ ওভারে  ৯ উইকেট হারিয়ে ৩১০ রান সংগ্রহ বাংলাদেশের। সিলেটের ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে ৩১০ রান করলেও ৯ উইকেট হারিয়ে বিপদেই আছে বাংলাদেশ।

nz-vs-bang-39

প্রথম দিন শেষে স্কোরকার্ড:
বাংলাদেশ: ৩১০/৯ (৮৫), মাহমুদুল হাসান জয়-৮৬ (১৬৬), নাজমুল হাসান শান্ত-৩৭ (৩৫),
গ্লেন ফিলিপ-১৬-৫৩-৪, কাইল জেমিসন-১৭-৫২-২

অথচ টস জিতে কন্ডিশনকে কাজে লাগিয়ে বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ। যা হতে দেয়নি উচ্চ বিলাসী শর্ট সিলেকশনে। এক মাহমুদুল হাসান জয় ছাড়া কোন ব্যাটারই টেস্ট মেজাজ দেখাতে পারেননি। সিলেটের উইকেটের যা অবস্থা তাতে বোলারদের জন্য কঠিন পরীক্ষা হওয়ার কথা। বলার মত কোন বোলিং বৈচিত্র্য না থাকলেও উইকেট পেতে সমস্যা হয়নি কিউদের। সমস্যা হবেই বা কেন ব্যাটিংয়ে যে বাংলাদশ।

বাংলাদেশী ব্যাটার পাওয়া মানেই যেন মরা উইকেটেও উইকেটের দেখা পাওয়া। এমনকি রিগুলার বোলার না হয়ে উইকেট পাওয়া সহজ যেন বাংলাদেশী ব্যাটারদের বিপক্ষে। সিনিয়র থেকে শুরু করে জুনিয়র কারো মধ্যেই দায়িত্ববোধের কোন বালাই খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুশফিক, মুমিনুলের মত অভিজ্ঞ ব্যাটাররাও কন্ডিশন কাজে লাগাতে পারেনি।

মাহমুদুল হাসান জয় আর জাকির হোসেনকে দিয়েই নতুন প্রজন্মের ওপেনিং স্টান্ট তৈরি করেছিল বাংলাদেশ। জাকির হাসনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকলেও, প্রত্যাশা পূরন করতে ব্যর্থ তিনি। ৪১ বল খেলে ১২ রান করে এজাজ প্যাটেলের বলে বোল্ড আউট হয়ে ফিরেছেন। তবে, তার ওপেনিং সঙ্গী মাহমুদুল হাসান জয় ১৬৬ বলে ৮৬ রানের একটি ঝলমলে ইনিংস খেলেছেন। 

মাহমুদুল হাসান জয়ের সামনে শত রান করার দুর্দান্ত সুযোগ থাকলেও তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। ইশ সোধীর বলে ড্যারেল মিশেলকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি।শতকের দেখা না  পেলেও প্রকৃত টেস্ট ব্যাটিং তার ব্যাট থেকে দেখা গেছে। শুধু এই ইনিংস নয় এর আগেও টেস্ট ব্যাটিং মেজাজের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন তিনি। 

বাংলাদেশের হয়ে এই সিরিজে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করা নাজমুল হাসান শান্তর কাছ থেকে বড় আশা ছিল বাংলাদেশের। শুরুতে ভাল কিছুর ইঙ্গিত দিলেও শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারেননি। টেস্ট ব্যাটিংয়ের কোন নমুনাই ছিল না অধিনায়কের ব্যাটে। যার খেসারত দিতে হয়েছে অনিয়মিত বোলার গ্লেন ফিলিপকে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে। নাজমুল হাসানর শান্ত আউট হয়েছেন ৩৫ বলে ৩৭ রানের ইনিংস খেলে।

অপরদিকে, বাংলাদেশের একমাত্র টেস্ট স্পেশালিস্ট ব্যাটার মানা হয় মুমিনুল হককে। ৭৮ বলে ৩৭ রানের ইনিংস খেলে তিনিও উইকেট দিয়েছেন গ্লেন ফিলিপসকে। বিসিবি মুমিনুল হককে টেস্ট ম্যাচের বাহিরে বিচেনয়ায় নেননা। তাছাড়া, বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ কম থাকায় দীর্ঘদিন পর পর মাঠে ফিরতে হয় মুমিনুলকে। যার প্রভাব ব্যাটেও পড়েছে। ভাল শুরুর পরেও ইনিংস বড় করতে পারছেন না এই ব্যাটার। 

অন্যদিকে, মুশফিকুর রহিম ২২ বলে ১২ রান করে এজাজ প্যাটেলের বলে আউট হয়েছেন। বাংলাদেশের মোস্ট ডিপেন্ডেবল ব্যাটার ধরা হয় মুশফিককে। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন এই ব্যাটার। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে থাকা মুশফিকের কাছে বড় ইনিংসের প্রত্যাশা থাকলেও তা তিনি পূরন করতে পারেননি।

অপরদিকে, আজকের ম্যাচে শাহাদাত হোসেনকে অভিষেক করিয়েছে বাংলাদেশ। অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিল দিপু। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি রাইট আর্ম অফ ব্রেক বল করতে পারেন তিনি। অলরাউন্ডিং ক্যাপাবিলিটি থাকায় টিম ম্যানেজমেন্টের নজড়ে আসে দিপু। অভিষেক ম্যাচকে রাঙ্গানোর ইচ্ছে থাকলেও ৫৪ বলে ২৪ রানের ইনিংস খেলে গ্লেন ফিলিপসের বলে আউট হন দিপু। তবে, এখনো ভাল কিছু করে দেখানোর সুযোগ আছে দিপুর সামনে।

তাছাড়া মেহেদী হাসান মিরাজ আজকের ম্যাচে ৭ নম্বর পজিশনে ব্যাটে এসে ভাল কিছু করতে পারেননি। ৩০ বলে ২০ রান করে কাইল জেমিসনের বলে ড্যারেল মিশেলকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। বিশ্বকাপে বিভিন্ন পজিশনে ব্যাট করে আলোচনায় এসেছিলেন মিরাজ। আজকের ম্যাচে উপরের দিকে ব্যাট করবেন মনে হলেও শেষ পর্যন্ত সুযোগ মেলে ৭ নম্বর পজিশনে। অথচ, সুযোগ পেলে উপরের দিকেই ভাল করেন মিরাজ।

উইকেট কিপার ব্যাটার হিসেবে সুযোগ পাওয়া নুরুল হাসান সোহানের সামনে সুযোগ ছিল ভাল কিছু করে দলে জায়গা করে নেয়ার। তবে , তিনি তা করতে পারেননি। টেস্ট ম্যাচেও আগ্রাসী ব্যাটিং মনোভাব দেখিয়ে ২৮ বলে ২৯ রান করে গ্লেন ফিলিপসের বলে আউট হয়েছেন। দায়িত্ব জ্ঞানহীন ব্যাটিং করে শুধু তিনিই আউট হননি, দলকেও বিপদে ফেলে গেছেন।

অপরদিকে, নাইম হাসান ৯ নম্বরে ব্যাটিংয়ে এসে ২৭ বলে ১৬ রানের ইনিংস খেলে কাইল জেমিসনের বলে আউট হয়েছেন। তাইজুল ইসলাম ২১ বলে ৮ আর শরীফুল ইসলাম ৮ বলে ১৩ রান করে নট আউট রয়েছেন। আগামীকাল শেষ দিনে ৩১০ থেকে বাংলাদেশের সংগ্রহটা বাড়িয়ে নিতে চাইবেন এই দুজন। যদিও আলোক স্বল্পতার কারনে ৮৫ ওভারেই দিনের খেলা শেষ ঘোষণা করেন আম্পায়রা। তা নাহলে হয়তো আজকেই বাংলাদেশকে অলআউট করার সুযোগ পেত নিউজিল্যান্ড।

নিউজিল্যান্ডের হয়ে গ্লেন ফিলিপস ১৬ ওভার বোলিং করে ৫৩ রান দিয়ে ৪ টি উইকেট দখল করেছন। গ্লেন ফিলিপস মুলত অনিয়মিত বোলার হিসেবে নিউজিল্যান্ডের হয়ে বল করে থাকে। সেই গ্লে ফিলিপসের বলই ঠিকমতো খেলতে পারেননি বাংলাদেশের টপ অর্ডার এবং মিডল অর্ডার ব্যাটাররা। যার স্বীকৃতি হিসেবে ৪ টি গুরুত্বপূর্ন উইকেট দখল করন এই অলরাউন্ডার।

তাছাড়াও, কাইল জেমিসন ১৭ ওভার বোলিং করে ৫২ রান দিয়ে ২ টি আর এজাজ প্যাটেল ২৪ ওভারে ৭৬ রান দিয়ে ২ টি উইকেট নেন। এর বাহিরেও ইশ সোধী ১৪ ওভারে ৭১ রান দিয়ে ১ টি উইকেট নিয়েছেন। ব্যাটিং সহায়ক উইকেটেও বাংলাদেশী ব্যাটারদের দুর্বল জায়গা খুঁজে বোলিং করে সফলতা পেয়েছেন কিউই বোলাররা।

মূলত, এই সিরিজের টেস্ট ম্যাচ দুটি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের অংশ হওয়ায়, ম্যাচ ‍দুটি গুরুত্বের সহিত  নিয়েছে নিউজিল্যান্ড দল। তা নাহলে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলে মূল দল বাংলাদেশে নাও আসতে পারত। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওডিআই সিরিজে দ্বিতীয় সারির দল পাঠিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। বাংলাদেশের মত সহজ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে টেস্ট দুটি জিতে ভাল পয়েন্ট টেবিলে ভাল অবস্থানে থাকতে চায় নিউজিল্যান্ড। ফলে ম্যাচ দুটি জয়ের ব্যাপারে অনেক উদগ্রীব নিউজিল্যান্ড দল।

অপরদিকে, ওডিআই থেকে শুরু করে টেস্ট, ক্রিকেটের সব ফর‌ম্যাটে বাংলাদেশের দু:সময় চলছে। ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর টেস্ট ম্যাচেও প্রথম দিনে ৯ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কায় বাংলাদেশ। এই রকম ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং লাইন আপকে কতটা পরীক্ষায় ফেলতে পারবে তা কালকের দিনে বোঝা যাবে।

তার আগে বাংলাদেশ নিজেদের কন্ডিশনকে কাজে লাগিয়ে বড় সংগ্রহের যে সুযোগ পেয়েছিল তার সদ্বব্যবহার করতে পারেনি। ১৮০ রান পর্যন্ত দুই উইকেটে থাকা বাংলাদেশের সামনে ৫০০ প্লাস রানের পরিস্কার সম্ভাবনা ছিল। মিডল অর্ডার ব্যাটারদের দায়িত্ব নিতে না পারার খেসারত হয়তো ম্যাচ হাতছাড়া করেও দিতে হতে পারে। 

দলে থাকা ১১ ব্যাটারের দশ জনই দুই অংকের ঘরে গিয়েছেলেন। যে একজন দু্ই অংক ছুঁতে পারেনি, সেই তাইজুল ইসলামও ৮ রান করে অপরাজিত আছেন। উইকেটে সেট হওয়ার পরও, বাংলাদেশ যেভাবে উইকেট বিলিয়েছে তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অতীত স্মৃতিই ফিরে এনেছে। ক্রিকেটে এত বছর পার করেও যেন ক্রিকেট টাই বুঝতে পারেনি বাংলাদেশ।

তাছাড়া, পাইপ লাইনে থাকা খেলোয়াড়রাও নিজেদের প্রমানে ব্যর্থ হওয়ায়, নিকট ভবিষ্যতে ভাল কিছুর আশা করতে পারছে না বাংলাদেশ। বিকল্প খেলোয়াড়ও না থাকায়, সমস্যা আরও তীব্রতর  হয়েছে। তাই বর্তমানে দলে থাকা খেলোয়াড়েদের থেকে সেরাটা বের করে আনতে না পারলে,আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে  হয়তো শুরুর থেকেই শুরু করতে হবে  বাংলাদেশকে।

2 thoughts on “টেস্ট ম্যাচের মর্ম কতটা বোঝে বাংলাদেশ

মন্তব্য করুন