ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট আন্তার্জাতিক ক্রিকেটের জন্য কতটা হুমকি

বিশ্ব ক্রিকেটের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ দিয়ে। ক্রিকেটের সেই যাত্রা এখনো চলমান। অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের পর ক্রিকেটের সাথে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ। ক্রিকেট এখন দেশ, মহাদেশ পেরিয়ে পূরো পৃথিবীর কাছে আকর্ষনীয় হয়ে ‍উঠেছে। ফুটবলের পর বিশ্বে দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা এখন ক্রিকেট।

t20-cricket-41

তবে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তায় গুরুত্ব হারাতে বসেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। ইন্ডিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট আইপিএল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিপিএল, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লীগ, পাকিস্তানের সুপার লীগ সহ তৈরি হয়েছে অসংখ্য ঘরোয়া লীগ। যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেয়েও বেশি অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকছে।

ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে টাকার ছড়াছড়িতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মনোযাগ হারাচ্ছে প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলতে অনেকে দেশের হয়ে খেলাকে বিদায় জানাচ্ছে আগে ভাগেই। পাশাপাশি দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেলে বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে অংশগ্রহন করতে দেখা যাচ্ছে অনেককে।

বর্তমান সময়ে প্লেয়িং নন প্লেয়িং সব দেশেই আয়োজন করা হচ্ছে লীগ ক্রিকেটের। ভারতের আইপিএল দিয়ে শুরু হয় ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জনপ্রীয়তা। আইপিএলের জনপ্রীয়তা দেখেই শুরু হয় বিপিএল, বিগব্যাশ আর পিএসএলের মত আসর। ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহের ঘাটতি থাকা কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশও এখন লীগ ক্রিকেট আয়োজন করছে।

মূলত টি-টোয়েন্টি দিয়ে বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট শুরু হলেও এখন যুক্ত হয়েছে টি-টেন লীগের মত জনপ্রিয় আসর। স্বল্প সময়ে শেষ হওয়ার কারনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে টি-টোয়েন্টি আর টি-টেন লীগগুলো। ফলে আসরগুলোেতে কারিকারি টাকা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিজ্ঞাপন মাধ্যমগুলো। 

কারিকারি অর্থের ঝনঝনাতিতে সাড়া দিচ্ছে ক্রিকেটে বড় বড় নামগুলো। সাকিব আল হাসান, রশিদ খান, লিয়াম লিভিংস্টোনরা দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন একদেশ থেকে আরেক দেশে। এমনকি ২ দিনের মাথায় ২ দেশে গিয়ে ক্রিকেট মাঠে নামারও নজির তৈরি হচ্ছে। 

ক্লান্তি দুর করতে দেশের হয়ে বিভিন্ন ফরম্যাট থেকে আগে ভাগেই সরে যাচ্ছেন ক্রিকেটারা। উইন্ডিজ প্লেয়ারদের মধ্যে অনেকেতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই পূরোপুরি সরিয়ে নিয়েছেন নিজেদের যাতে বিভিন্ন দেশের ফ্রাঞ্চাইজি লীগে অংশ নিতে পারেন।

টাকার গন্ধই মূলত ক্রিকেটারদের উৎসাহিত করছে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রতি। যেখানে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে দুই এক মাসেই কামিয়ে ফেলছে কোটি কোটি টাকা সেখানে সম পরিমান টাকা উপার্জন করতে কয়েক বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থাকতে হচ্ছে ক্রিকেটারদের। তাছাড়া বছরে ৩ থেকে ৪ টি লীগে অংশগ্রহন করে পাচ্ছেন বড় অংকের অর্থ উপার্জেনের সুযোগ।

অর্থের খেলায় সব লীগকে ছাড়িয়ে এক নম্বরে রয়েছে আইপিএল। একেক জন খেলোয়াড়কে কিনতে ১৭ কোটি টাকাও খরচ করতে দেখা যাচ্ছে টিমগুলোককে। আইপিএলের এক আসরে সুযোগ পেয়েই কোটিপতি বনে যাচ্ছেন ক্রিকেটাররা। কোন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহন না করেও কোটি টাকা পাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে আইপিএলের মত আসর।

শুধু আইপিএল নয় বিগ ব্যাশ, পিএসএল, বিপিএলও খেলোয়াড় কিনতে কম খরচ করছে না। ক্যাটাগরি অনুযায়ী একেকজন খেলোয়াড়ের পেছনে ৫০ লাখ থেকে ৭ থেকে ৮ কোটি খরচ করছে ফ্রাঞ্চাইজি মালিকরা। ভাল মানের ক্রিকেটার পেতে নিলামের বাহিরেও সরাসরি সাইনিং করেও চড়া মুল্যে  খেলোয়াড় আনছে দলগুলো। 

পূরো বছরে বিভিন্ন দেশে গিয়ে খেলে রশিদ খান, অ্যান্দ্রে রাসেলরা আয় করছেন ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা। যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ গ্রহন করে পূরো ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অনেকে ইনকাম করতে পারছেন না। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশগুলোর সেরা খেলোয়াড়দের ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। 

এর বাহিরেও বর্তমানে সবচেয়ে বড় করে যে বিষয়টি মাথা চাড়া দিচ্ছে তা হল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে খেলোয়াড় সরিয়ে শুধু ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলতে খেলোয়াড়দের কাছে অফার পাঠানো হচ্ছে। এর জন্য বড় অংকের অর্থের অফারও দেয়া হচ্ছে খেলোয়াড়দের সামনে। একটি ফ্রাঞ্চাইজির হয়ে পূরো বছর খেলতে ৬০ থেকে ৬৫ কোটি টাকারও অফারও তৈরি করা হচ্ছে। 

মূলত আইপিএলের দলগুলোর বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে দল রয়েছে। যেগুলো পরিচালনা করতে নামি দামি খেলোয়াড়দের সব সময় পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তারা অনেকের কাছে অফার পাঠাচ্ছে দেশের সাথে চুক্তি না করে তাদের সাথে চুক্তি করতে। যা করলে দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতে অনুমতি নিতে হবে ফ্রাঞ্চাইজি দলগুলোর কাছ থেকে। 

তবে দেশের হয়ে খেলতে ফ্রাঞ্চাইজি লীগের প্রতি অনীহাও লক্ষ্যে করা গেছে অনেকের মধ্যে। যে তালিকায় অস্ট্রেলিয়ার মিশেল স্টার্ক, ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস সহ অল্প কিছু নাম রয়েছে। যারা গতানুগতিক ধারার বাহিরে গিয়ে বিভিন্ন  ঘরোয়া আসরকে না করেছেন। তবে সেই তালিকা খুব বেশি নয়।

তবে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট মানেই যে শুধু খেলোয়াড়দের লাভ তা নয়। ফ্রাঞ্চাইজি টিম সহ আয়োজক দেশের ক্রিকেট বোর্ডও অনেক লাভবান হয় এই আসর থেকে। বিসিসিআই বিজ্ঞাপন মিডিয়া থেকেই প্রায় এক আসরেই আয় করে ৯৯ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি বিভিন্ন দলগুলোকে স্পন্সর করায় দলগুলোও অনেক লাভবান হচ্ছে। 

এতকিছুর পরও বিভিন্ন দেশ তাদের গুরুত্বপূর্ন খেলোয়াড়দের শুধু দেশের হয়ে খেলার জন্যও বিভিন্ন অফার তৈরি করছে। খবর রটেছে ইংলিশ তারকা হ্যারি ব্রুককে ধরে রাখতে সে দেশের বোর্ড বড় অংকের বার্ষিক অফার দিয়েছে ব্রুককে। তবে সেই অফার তিনি নেবেন কিনা তা সময় বলে দেবে। 

এক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড অনেকটা স্বস্তির জায়গায় আছে। দেশের বাহিরের ফ্রাঞ্চাইজি দলগুলোর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই। মূলত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভাল কিছু করে দেখাতে না পারায় বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের দলে ভেড়ানোর প্রতি কোন দেশকেই বড় আগ্রহ দেখাতে দেখা যায়ানি।

বিষয়টি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কিছুটা অসম্মানের হলেও বিসিবির জন্য স্বস্তির জায়গা। একমাত্র সাকিব আল হাসান ছাড়া ‍আর কাউকেই বাহিরের লীগ থেকে অফার করা হচ্ছে না। তবে ছোট ছোট দু একটি লীগে মুশফিক, তাসকিনদের ডাক পড়লেও ক্রিকেটে দলগুলো খুব স্বনামধন্য নয়। 

তবে আর যাই হোক ১৪৬ বছরের ক্রিকেট এই পর্যন্ত গঠন হয়েছে তিলে তিলে। যেক্ষেত্রে কোন ভুমিকা ছিল না ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট দলগুলোর। তবে বিগত এক যুগেই পাল্টে গেছে ক্রিকেটের চিত্র। যেখানে খেলার চেয়ে অর্থের কথাই বেশি ভাবা হচ্ছে। 

ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের অর্থের প্রভাবটা পড়ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও। যার প্রমাণ, সর্বশেষ অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে ৬ দলের অংশগ্রহনে হওয়া টুর্নামেন্টে রিজার্ভ ডে রাখা হয়েছিল শুধু ভারত পাকিস্তান ম্যাচে। যা শুধু বাড়তি লাভের আশায়। মূলত ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে অর্থ উপার্জনের লোভই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মত আসরে এই  ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করে। 

ফ্রাঞাইজি ক্রিকেটের প্রভাবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিভিন্ন ফর‌ম্যাট বন্ধেরও চিন্তা আসছে আইসিসির কাছ থেকে। ফলে টেস্ট কিংবা ওডিআই যেকোন ফরম্যাট ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়েছে। যেকোন সময় ওডিআই ক্রিকেট বিলুপ্ত কিংবা টেস্ট ম্যাচের দিন কমিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত আসলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

ইতিমধ্যেই, ২০২৫ সালে ওডিআই চ্যাম্পিয়ন ট্রফিকে অন্য ফরম্যাটে আয়োজনের গুঞ্জন আসছে। তবে সেটা কি টোয়েন্টি নাকি নতুন কোন ফরম্যাট তৈরি করে খেলার চিন্তা তা স্পষ্ট নয়। যার দারা প্রমান হয়যে আন্তার্জাতিক ক্রিকেটেই আগ্রহ হারাচ্ছে খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ইন্ডিয়া পরিচালিত আইসিসি। 

ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট  আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যে স্বন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জয় গান সুবিধা ভোগিদের। বিভিন্ন ক্রিকেট লিজেন্ডরা বাহিরের ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের নিরুৎসাহিত করলেও তা খুব একটা কাজ হচ্ছে না। বেশি বেশি ক্রিকেট খেলায় ইনজুরিতে পড়ে ক্যারিয়ার সমস্যায় ভুগছেন অনেকেই। 

নিউজিল্যান্ডের কেন উইলিয়ামসন,ইংল্যান্ডের বেন স্টোকসরাও চোঁটে পড়ছেন ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে অংশগ্রহন করে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাহিরে থেকে ছোট হয়ে যাচ্ছে তাদের ক্রিকেট ক্যারিয়ার । তবে যাই হোক, জয় হোক ক্রিকেটের, ক্রিকেটীয় চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক পূরো দুনিয়ায়।

One thought on “ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট আন্তার্জাতিক ক্রিকেটের জন্য কতটা হুমকি

মন্তব্য করুন